বিশ্বের পরিত্যক্ত শহর

এখনো বিশ্বের পরিত্যক্ত শহর বা কিছু জায়গা রয়েছে যেখানে একসময় বহু মানুষের ভিড় থাকলেও এখন সেগুলো পরিত্যক্ত। একসময় প্রাণশক্তিতে পরিপূর্ণ থাকলেও বর্তমানে শহরগুলোতে শুধুই শূন্যতা, জনমানবহীনতা বিরাজ করছে। একটি স্থান পরিত্যক্ত হওয়ার পেছনে নানা কারণ বা ঘটনা থাকতে পারে। আমরা জানি যুদ্ধের সময় বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। অনেক স্থানে আবার পারমাণবিক বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানোর ফলে তা বসবাস অযোগ্য হয়ে পড়ে।

সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশ, বিভিন্ন রহস্যময় জায়গা সম্পর্কে আমাদের আগ্রহের শেষ নেই। কিন্তু এমন অনেক আশ্চর্য শহর ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন দেশে, যেগুলির সম্পর্কে আমরা হয়ত এখনও অনেকটাই জানি না। টেলিভিশনের পর্দা হোক বা রুপালি পর্দা, প্রায়ই পরিত্যক্ত শহরের কথা আমাদের কানে এসে পৌঁছায়। একসময় যে শহরগুলি গমগম করত, সেখানেই আজ যেন ভূতের বাস।একসময় প্রানশক্তিতে পরিপূর্ণ থাকলেও বর্তমানে শহরগুলিতে শুধুই শূন্যতা, জনমানবহীন।

আসলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ, অর্থনৈতিক সংকট, পারমাণবিক দূষণের মতো নানা কারণে পৃথিবীর বহু শহর একেবারেই পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছে। পৃথিবীতে এমন শহরের সংখ্যা কিন্তু কম নেই। সেই সব শহরের কিছু কিছু এলাকা সর্বসাধারণের জন্য নিষিদ্ধ হলেও এখন কিছু কিছু এলাকা পর্যটকদের জন্যে খুলে দেওয়া হয়েছে।  আজকের এই আর্টিকেলে এমন বিশ্বের পরিত্যক্ত শহর সম্পর্কে আপনাদের জানাবো। তাই চলুন দেরি না করে এখনি আর্টিকেলটি শুরু করা যাক:

১)ওরাদ্যুর-সুর-গ্লেন, ফ্রান্স

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকার চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই পরিত্যক্ত গ্রামটি। ১৯৪৪ সালের ১০ জুন পর্যন্ত গ্রামটিতে কারো আঁচড় পড়েনি। পরবর্তীতে নাজি পার্টির সামরিক বাহিনী ওয়াফেন এস এস গ্রামটিতে আক্রমণ করে। গ্রামের পুরুষদের সারি বেঁধে গুলি করে হত্যা করা হয়। নারী ও শিশুরা গির্জায় আশ্রয় নেওয়ায় তা বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেওয়া হয়। যুদ্ধের অন্যতম নেতা চার্লস ডি গল সিদ্ধান্ত নেন, এটিকে নাজি বাহিনীর নৃশংসতার একটি নিদর্শন হিসেবে রেখে দেওয়ার। ১৯৯৯ সালে একটি স্মারক জাদুঘরসহ এর কাছে নতুন একটি গ্রাম গড়ে তোলা হয়েছে। 

২) ক্রাকো, ইতালি

ইতালির দক্ষিণের একেবারে শেষ প্রান্তে এই শহরের অবস্থান। চমৎকার স্থাপত্যশৈলীর এই শহরটি সুয়েজ ও পানির লাইন সংক্রান্ত কাজের জন্য কয়েকবার ভূমিধ্বসের শিকার হয়৷ গত শতাব্দীর ষাট দশক থেকে অধিবাসীরা শহরটি ত্যাগ করতে কেন। ১৯৮০ সালে ইরিপিনিস ভূমিকম্পের পর শহরটি জনশূন্য হয়ে পড়ে। এখন এটি সিনেমার শুটিং ও পর্যটন কেন্দ্র। জেমস বন্ড সিরিজের ‘কোয়ান্টাম অব সোলেস’ এর শুটিং হয়েছিল এখানে।

৩) কোলমানস্কপ, নামিবিয়া

নামিবিয়ার মরু অঞ্চলের একসময়ের জমজমাট এই শহরটির বহু ভবন এখন ধুলোয় মিশে গেছে। ১৯০৮ সালে স্থানীয় শ্রমিক জাকারিয়াস লেভালা এখানে হীরা পাওয়ার পর শহর গড়ে ওঠে। এরপর জার্মানি থেকে আগত স্বর্ণসন্ধানীদের দৃষ্টি পড়ে এর ওপর। ১৯৫৬ সালে পরিত্যক্ত হয়ে যাওয়া এই মরুশহরে জার্মান ধরনে নির্মিত বলরুম, ক্যাসিনো এমনকি ট্রাম চলাচলের ব্যবস্থাও ছিল।

৪) হাশিমা দ্বীপপুঞ্জ, জাপান

নাগাসাকির উপকূলে অবস্থিত এই দ্বীপটিকে বলা হতো ‘ব্যাটলশিপ আইল্যান্ড’। ১৮৮৭ সাল থেকে ১৯৭৪ সালের ভেতর এখানে ছিল সমুদ্র তলদেশ থেকে কয়লা উত্তোলনের ব্যবস্থা। কয়লার চাহিদা ফুরোনোর সঙ্গে সঙ্গে এর গুরুত্বও কমে আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে এর নাম। এখানে ছিল একটি লেবার ক্যাম্প। হাজারেরও বেশি কোরীয় ও চীনা যুদ্ধবন্দী শাস্তি পেয়েছেন এখানে।

৫) গ্রান্ড-বাসাম, আইভরি কোস্ট

এখানে এখনো লোকবসতি কম নয়। তবে অনেক পুরনো ভবন এখন একেবারেই জনশূন্য। উপনিবেশে পরিণত হবার অনেক আগে ষোল শতকে এখানে অ্যাপোলোনিয়ানরা বসতি গড়ে তোলে। ছিল জমজমাট বন্দর, চমৎকার মাছ চাষ হতো এখানে। একসময়ের ফরাসি উপনিবেশের রাজধানীতে পরিণত হওয়া এই শহরের পুরনো পোস্ট অফিস, কেন্দ্রীয় আফ্রিকান ব্যাংক ও দি হোটেল দে ফ্রান্স এখন ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ।

৬) ভরকুটা, রাশিয়া

রাশিয়ার রুক্ষ উত্তর আর্কটিক অঞ্চলবর্তী ভরকুটাকে ঘিরে আছে পরিত্যক্ত শহরতলি গ্রাম। গুলাগে পাঠানো বন্দীদের দিয়ে গত শতকের ত্রিশ থেকে ষাটের দশকে এখানে কয়লা খনন ও উত্তোলন করানো হতো। তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের এখান থেকে সরিয়ে উচ্চ বেতনে অন্যান্য জায়গায় কাজে পাঠানো হয়। সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর এখানে থাকা বন্দীরাও চলে যান অন্যান্য জায়গায়৷ কয়লা উত্তোলন বন্ধ হয়, পড়ে থাকে শূন্য সব ঘরবাড়ি। প্রতি শীতে সেগুলো ঢেকে যায় বরফের চাদরে।

৭) ভারোশা, সাইপ্রাস

সাইপ্রাসের শহর ফামাগুস্তার এই এলাকাটি একসময় ছিল হাজারো মানুষের পদচারণায় কোলাহলমুখর এক পর্যটন কেন্দ্র। ১৯৭৪ সালে সাইপ্রাসে তুরস্ক আক্রমণ করলে ভারোশা পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। তখন থেকে এই রিসোর্টের মতো শহরটির ভবনগুলো নিঃস্ব হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে ক্ষয় হচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এটিকে আবার পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালে সমুদ্র সৈকতে আবারো পর্যটন সুবিধা চালু হয়েছে, এমনকি অনুমতি রয়েছে তুরস্কেরও!

৮) ইপেকিউয়েন, আর্জেন্টিনা

ল্যাগুনা ইপেকিউয়েন এর তীরে গত শতাব্দীর বিশের দশকে গড়ে ওঠে আধুনিক পর্যটন সুবিধাসম্পন্ন এই নগরীটি। রাজধানী শহর বুয়েন্স এইরেস থেকে অনেকে স্বল্প সময়ের ছুটি কাটাতে এখানে আসতেন। এর লোনা ধরণের চমৎকার নীলাভ পানি ছিল পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ।১৯৮৫ সালে ‘সেইকি’ নামে খুব দুর্লভ অথচ শক্তিশালী এক সামুদ্রিক ঝড়ে পুরো এলাকায়  মহাজলোচ্ছ্বাস হয়! ২ যুগের প্রচেষ্টার পর ২০০৯ সালে এসে পানি নামানো সম্ভব হয়। লবণভর্তি হয়ে ভবনগুলো রয়ে যায় পরিত্যক্ত অবস্থায়।

৯) কায়াকোয়, তুরস্ক

বর্তমানে জাদুঘরে পরিণত করা এই গ্রামটি পেয়েছে ইউনেস্কোর ‘বিশ্ব বন্ধুত্ব ও শান্তিপূর্ণ গ্রাম’ এর স্বীকৃতি। তুরস্কের দক্ষিণ পশ্চিমের এই শান্তিময় গ্রামটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে ছারখার হয়ে যায়। গ্রীস ও তুরস্কের লড়াইয়ের যাঁতাকলে পড়ে এখানকার মানুষ নিরাপত্তার জন্য গ্রাম ছেড়ে চিরতরে চলে যায়। তারা আর কখনোই এই গ্রামে ফিরতে পারেননি।

সবশেষে

বিশ্বের বিভিন্ন পরিত্যক্ত জায়গা গুলো বর্তমানে দর্শনার্থীদের পরিদর্শনের স্থান হয়েছে। বিভিন্ন কারণে কালে কালে এসব স্থান বসবাসের অযোগ্য হওয়ার ফলে স্থানগুলো পরিত্যক্ত হয়েছে। তবে বর্তমান যুগে এসে এসব পরিত্যক্ত স্থান দেখার জন্য অনেক মানুষ ভিড় জমায়। আপনি চাইলে খুব সহজেই এসব স্থান ঘুরে দেখতে পারেন, এবং এসব স্থানের ইতিহাস সম্পর্কে আপনি জানতে পারেন। উপরোক্ত আলোচনায় বলা বিশ্বের পরিত্যক্ত শহর যা আপনি পরিদর্শন করে দেখতে পারেন। আশা করি আজকের বিশ্বের পরিত্যক্ত শহর আর্টিকেলটি থেকে আপনি কিছুটা হলেও উপকৃত হয়েছেন। আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।

More: পিএসজি বনাম ডর্টমুন্ড (সেমিফাইনাল ২,লেগঃ১) Psg vs Dortmund

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top